আন নিসা, আয়াত ৫৫-৭৫

পৃষ্ঠা নং-২৫৮

করা হত। খানায়ে-কা’বার কোন বিশেষ খেদমতের জন্য যারা নির্বাচিত হত, তারা গোটা সমাজ তথা জাতির মাঝে সম্মানিত ও বিশিষ্ট বলে পরিগণিত হত। সে জন্যই বায়তুল্লাহ্‌র বিশেষ খেদমত বিভিন্ন লোকের মাঝে ভাগ করে দেয়া হত। জাহেলিয়াত আমল থেকেই হজ্বের মওসুমে হাজীদিগকে ‘যমযম’ কূপের পানি পান করানোর সেবা মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিতৃব্য হযরত আব্বাসের (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) উপর ন্যস্ত ছিল। একে বলা হত ‘সেকায়া’। এমনি করে অন্যান্য আরো কিছু কিছু সেবার দায়িত্ব হুযূর (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্য পিতৃব্য আবু তালেবের উপর এবং কা’বা ঘরের চাবি নিজের কাছে রাখা এবং নির্ধারিত সময়ে তা খুলে দেয়া ও বন্ধ করার ভার ছিল ওসমান ইবনে তালহার উপর।

এ ব্যাপারে স্বয়ং ওসমান ইবনে তালহার ভাষ্য হল এই যে, জাহেলিয়াত আমলে আমরা সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিন বায়তুল্লাহ্‌র দরজা খুলে দিতাম এবং মানুষ তাতে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করত। হিজরতের পূর্বে একবার মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতিপয় সাহাবীসহ বায়তুল্লা হতে প্রবেশের উদ্দেশে তশরীফ নিয়ে গেলে ওসমান (যিনি তখনও পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি) তাঁকে ভেতরে প্রবেশে বাধা দিলেন এবং অত্যন্ত বিরক্তি প্রদর্শন করলেন। কিন্তু মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত ধৈর্য ও গাম্ভীর্য সহকারে ওসমানের কটুক্তিসমূহ সহ্য করে নিলেন। অতঃপর বললেন, হে ওসমান! হয়তো তুমি এক সময় বায়তুল্লাহ্‌র এই চাবি আমার হাতেই দেখতে পাবে। তখন যাকে ইচ্ছা এই চাবি অর্পন করার অধিকার আমারই থাকবে। ওসমান ইবনে তালহা বলল, তাই যদি হয়, তবে সেদিন কোরাইশরা অপমানিত অপদস্থ হয়ে পড়বে। হযূর বললেন, না, তা নয়। তখন কোরাইশরা আযাদ হবে, তারা হবে যথার্থ সম্মানে সম্মানিত। এ কথা বলতে বলতে তিনি বায়তুল্লাহ্‌র ভেতরে তশরীফ নিয়ে গেলেন। (ওসমান বলেন), তারপর আমি যখন আমার মনের ভেতর অনুসন্ধান করলাম, তখন আমার যেন নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেল যে, তিনি যাকিছু বললেন, তা অবশ্যই ঘটবে। সে মুহুর্তেই আমি মুসলমান হয়ে যাবার সংকল্প নিয়ে নিলাম। কিন্তু আমি আমার সম্প্রদায়ের মতিগতি পরিবর্তিত দেখতে পেলাম। তারা আমাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করতে লাগল। কাজেই আমি আর আমার (মুসলমান হওয়ার) সংকল্প বাস্তবায়িত করতে পারলাম না। অতঃপর মক্কা বিজিত হয়ে গেলে পর রসূলে করীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডেকে বায়তুল্লাহ্‌র চাবি চাইলেন। আমি তা পেশ করে দিলাম।

কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, ওসমান ইবনে তালহা চাবি নিয়ে বায়তুল্লাহ্‌র উপরে উঠে গেলেন এবং হযরত আলী (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) মহানবীর নির্দেশ পালনকল্পে তার নিকট থেকে বলপূর্বক চাবি ছিনিয়ে নিয়ে হুযূরের হাতে অর্পণ করলেন। যাহোক, বায়তুল্লায় প্রবেশ এবং সেখানে নামায আদায় করার পর মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বাইরে বেরিয়ে এলেন, তখন পুনরায় আমার হাতেই সে চাবি ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ এই নাও, এখন থেকে এ চাবি কেয়ামত পর্যন্ত তোমার বংশধরদের হাতেই থাকবে। অন্য যে কেউ তোমাদের হাত থেকে এ চাবি ফিরিয়ে নিতে চাইবে, সে হবে যালেম, অত্যাচারী। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের হাত থেকে এ চাবি ফিরিয়ে নেবার কোন অধিকার করোরই থাকবে না। এতদসঙ্গে তিনি এই হেদায়েত করলেন যে, বায়তুল্লাহ্‌র এই খেদমত তথা সেবার বিনিময়ে তোমরা যে সম্পদ প্রাপ্ত হবে, তা শরীয়তের রীতি মোতাবেক ব্যবহার করবে।

ওসমান ইবনে তলহা বলেন, যখন আমি চাবি নিয়ে হৃষ্টচিন্তে চলে আসছিলাম, তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। বললেন, আমি যা বলেছিলাম তাই হল নাকি? তৎক্ষণাৎ আমার সে কথাটি মনে হয়ে গেল, হিজরতে পূর্বে যা তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, “একদিন এ চাবি আমার হাতে দেখতে পাবে।” তখন আমি নিবেদন করলাম, নিঃসন্দেহে আপনার কথা বাস্তবায়িত হয়েছে-আর এক্ষণে আমিও কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলাম।– (মাযহারী)

হযরত ফারূকে আ’যম ওমর ইবনে খাত্তাব (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন যে, সেদিন যখন মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বায়তুল্লাহ্ থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তাঁর মুখে এ আয়াতটি আবৃত হচ্ছিল। ۞ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا

অর্থাৎ, “আল্লাহ্ তাআলা তোমাদিগকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার অধিকারীর নিকট অর্পণ করে দাও।” এ হুকুমের লক্ষ্য সাধারণ মুসলমানরাও হতে পারে কিংবা বিশেষভাবে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গও হতে পারেন। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট বিষয় হল এই যে, এমন সবাই এর লক্ষ্য যারা আমানতের রক্ষক বা আমানতদার। এতে সাধারণ জনগণ ও শাসকবর্গ সবাই অন্তর্ভুক্ত।

আমানত পরিশোধের তাকীদঃ বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে এই যে, যার দায়িত্বে কোন আমানত থাকবে, সে আমানত প্রাপককে পৌঁছে দেয়া তার একান্ত কর্তব্য। রসূলে করীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমানত প্রত্যর্পণের ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেছেন। হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এমন খুব কম হয়েছে যে, রসূলে করীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে একথা বলেননি-

“যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই। “আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার ধর্ম নেই।”-(শোআবুল ঈমান)

খেয়ানত মুনাফেকীর লক্ষণঃ বোখারী ও মুসলিমের হযরত আবু হোরায়রা (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) ও হযরত ইবনে ওমর (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন মুনাফেকীর লক্ষণসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি লক্ষণ এটাও বলেছিলেন যে, যখন তার কাছে কোন আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে।

আমানতের প্রকারভেদঃ এখানে লক্ষণীয় যে, কুরআন কারীম আমানতের বিষয়টিকে أَمَانَاتِ বহুবচনে উল্লেখ করেছে। এতে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, কারো নিকট অপর কারো কোন বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধুমাত্র ‘আমানত’ নয়, যাকে সাধারণতঃ আমানত বলে অভিহিত করা হয় এবং মনে করা হয়; বরং আমানতের আরও কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। আয়াতের শানে-নুযূল প্রসঙ্গে এখনই যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তাও কোন বস্তুগত আমানত ছিল না। কারণ, বায়তুল্লাহ্‌র চাবি বিশেষ কোন বস্তু নয়, বরং তা ছিল বায়তুল্লাহ্‌র খেদমতের একটা পদের নিদর্শন।

রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাসমূহ আল্লাহ্ তা’আলার আমানতঃ এতে প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রীয় যত পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সেসবই আল্লাহ্ তাআলার আমানত। যাদের হাতে নিয়োগ-বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সে-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ