আলি-ইমরান ৩০-৬২

পৃষ্ঠা নং-১৭৯

ব্যাপার। কারণ, তিনি পিতা ও মাতা উভয় ব্যতিরেকেই জন্মগ্রহণ করেন।

          ইহুদীরা ঈসার (আঃ) বিরুদ্ধে খোদায়ী দাবি করার অভিযোগও এনেছিল। কুরআনের অনেক আয়াতে এর বিপরীতে ঈসা (আঃ)-এর বন্দেগী ও মানবত্বের স্বীকারোক্তি বর্ণিত হয়েছে।

          চতুর্থ অঙ্গীকার وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, অবিশ্বাসীর বিপক্ষে আপনার অনুসারীদের কেয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী রাখা হবে। আয়াতে অনুসরণের অর্থ হযরত ঈসার (আঃ) নবুওয়াতে বিশ্বাস করা ও স্বীকারোক্তি করা। এর জন্য যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করা শর্ত নয়। এভাবে খ্রীষ্টান ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় তাঁর অনুসারীদের অন্তর্ভূক্ত। কারণ, মুসলমানরাও ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াতে বিশ্বাসী। এটা ভিন্ন কথা যে, এতটুকু বিশ্বাসই পরকালের মুক্তির জন্যে যথেষ্ট নয়; বরং ঈসা (আঃ)-এর যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করার উপর পরকালের মুক্তি নির্ভরশীল। হযরত ঈসা (আঃ)-এর অকাট্য বিধানাবলীর মধ্যে একটি ছিল এই যে, পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতিও ঈমান আনতে হবে। খ্রীষ্টানরা এটি পালন করেনি। ফলে তারা পরকালের মুক্তি থেকে বঞ্চিত।  মুসলমানরা এটিও পালন করেছে। ফলে তারা পরকালের মুক্তির অধিকারী হয়েছে। কিন্তু জগতে ইহুদীদের বিপক্ষে বিজয়ী রাখার অঙ্গীকার শুধু হযরত ঈসার (আঃ) নবুওয়াতের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ অঙ্গীকার অনুযায়ী ইহুদীদের বিপক্ষে খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের বিজয় সব সময় অর্জিত হয়েছে এবং নিশ্চিতরূপেই কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

এ অঙ্গীকারের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, ইহুদী জাতির বিপক্ষে খ্রীষ্টান ও মুসলমান জাতি সর্বদাই বিজয়ী রয়েছে। তাদের রাষ্ট্রই দুনিয়ার যত্রতত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

          ইসরাঈলের বর্তমান রাষ্ট্রঃ ইসরাঈলের বর্তমান রাষ্ট্র দেখে এ ব্যাপারে সন্দেহ করা যায় না। কারণ, প্রথমতঃ এ রাষ্ট্রটি রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টানদের একটি সামরিক ছাউনী ছাড়া কিছুই নয়। ওরা এটিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। যদি একদিনের জন্যও এর মাথার উপর থেকে রাশিয়া, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য রাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নেয়, তবে বিশ্বের মানচিত্র থেকে এর অস্তিত্ব মুছে যাওয়া সুনিশ্চিত। একারণে বাস্তবধর্মী লোকদের দৃষ্টিতে ইসরাঈলের এ ইহুদী রাষ্ট্রটি একটি আশ্রিত রাষ্ট্রের অতিরিক্ত কিছু নয়। যদি একে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রও ধরে নেয়া হয়, তবুও খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের সমষ্টির বিপরীতে এ যে নেহায়তই একটি আপাংক্তেয় রাষ্ট্র, তা কোন সুস্থবুদ্ধি ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না। এ থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে বলা যায় যে, কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে কিছুদিনের জন্যে ইহুদীদের প্রাধান্য বিস্তারের সংবাদ স্বয়ং ইসলামী রেওয়ায়াতসমূহেই দেয়া হয়েছে। যদি দুনিয়ার আয়ু ফুরিয়ে এসে থাকে এবং কেয়ামত নিকটবর্তী হয়ে থাকে, তবে এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইসলামী রেওয়ায়াতের পরিপন্থী নয়। এহেন ক্ষণস্থায়ী আলোড়নকে সাম্রাজ্য অথবা রাষ্ট্র বলা যায় না।

          পঞ্চম অঙ্গীকার এই যে, কেয়ামতের দিন সব ধর্মীয় মতবিরোধের মীমাংসা করা হবে। সময় এলে এ অঙ্গীকারও পূর্ণ হবে যে,

ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

হযরত ঈসা (আঃ)-এর হায়াত ও অবতরণের প্রশ্নঃ জগতে একমাত্র ইহুদীরাই একথা বলে যে, ঈসা (আঃ) নিহত ও শূলবিদ্ধ হয়ে সমাহিত হয়ে গেছেন এবং পরে জীবিত হননি। কুরআনের সূরা নিসার আয়াতে ওদের এ ধারণার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতেও وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ বাক্যাংশে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাআলা ঈসার (আঃ) শত্রুদের চক্রান্ত স্বয়ং তাদের দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, যেসব ইহুদী তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ঘরে প্রবেশ করেছিল, আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্য থেকেই এক ব্যক্তির আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে হুবুহু ঈসার (আঃ) ন্যায় করে দেন। অতঃপর হযরত ঈসাকে (আঃ) জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নেন। আয়াতের ভাষা এরূপঃ  وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ “তারা ঈসাকে হত্যা করেনি, শূলীতেও চড়ায়নি। কিন্তু আল্লাহ্‌র কৌশলে তারা সাদৃশ্যের ধাঁধাঁয় পতিত হয় এবং নিজেই লোককেই হত্যা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে”।

          এ দুই দলের বিপরীতে ইসলামের বিশ্বাস আলোচ্য আয়াত ও অন্যান্য কতিপয় আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে ইহুদীদের কবল থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন। তাঁকে হত্যা করা হয়নি এবং শূলীতেও চড়ানো হয়নি। তিনি জীবিতাবস্থায় আকাশে বিদ্যমান রয়েছেন এবং কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে আকাশ থেকে অবতরণ করে ইহুদীদের বিপক্ষে জয়লাভ করবেন, অবশেষে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন।

          এ বিশ্বাসের উপর সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ইজমা তথা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজর ‘তালখীস’ গ্রন্থের ৩১৯ পৃষ্ঠায় এ ইজমা উদ্ধৃত করেছেন।

          এখানে আমরা একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিষয়টি চিন্তা করলে আলোচ্য প্রশ্নে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। তা এই যে, সূরা আলে-ইমরানের একাদশতম রুকুতে আল্লাহ্‌ তাআলা পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের উল্লেখ প্রসঙ্গে হযরত আদম, নূহ, ইবরাহীম ইমরানের বংশধরের উল্লেখ একটিমাত্র আয়াতে সংক্ষেপে করেছেন। এরপর প্রায় তিন রুকুর বাইশটি আয়াতে হযরত ঈসা (আঃ) ও তাঁর পরিবারের উল্লেখ এমন বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে যে, কুরআন যার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর উল্লেখও এমন বিস্তারিতভাবে করা হয়নি। হযরত ঈসা (আঃ)-এর মাতামহীর উল্লেখ, তাঁর মানতের বর্ণনা, জননীর জন্ম, তাঁর নাম, তাঁর লালন-পালনের বিস্তারিত বিবরণ, ঈসা (আঃ)-এর জননীর গর্ভে আগমন, অতঃপর জন্মের বিস্তারিত অবস্থা, জন্মের পর জননী কি পানাহার করলেন, শিশু সন্তানকে নিয়ে গৃহে আগমন, পরিবারের লোকদের ভর্ৎসনা, জন্মের পরপরই ঈসা (আঃ)-এর বাকশক্তি প্রাপ্তি, যৌবনে পদার্পণ, স্বজাতিকে ধর্মের প্রতি আহ্বান, তাদের বিরোধিতা, সহচরদের সাহায্য, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, জীবিতাবস্থায় আকাশে উত্থিত হওয়া প্রভৃতি। এরপর মুতাওয়াতির হাদিসসমূহে তাঁর আরও গুণাবলী, আকার আকৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণও এমনিভাবে দেয়া হয়েছে যে, সমগ্র কুরআন ও হাদীসে কোন পয়গম্বরের জীবনালেখ্য এমন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়টিই সকলের পক্ষে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এরূপ কেন করা হয়েছে এবং এর তাতপর্য কি?

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ