পৃষ্ঠা নং- ১৮০
সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত নবী কারীম (সাঃ) হলেন সর্বশেষ নবী, তারপর আর কোন নবী আসবেন না। এ কারণে, তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভাব্য ঘটনাবলী সম্পর্কে স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই একদিকে তিনি পরবর্তীকালে অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং সাধারণ গুণাবলীর মাধ্যমে ও অনেকের বেলায় নাম উল্লেখ করে তাঁদের অনুসরণ করতে জোর তাকিদ করেছেন। অপরদিকে উম্মতের ক্ষতিসাধনকারী পথভ্রষ্ট লোকদের পরিচয়ও বলেছেন।
পরবর্তীকালে আগমনকারী পথভ্রষ্টদের মধ্যে সবচাইতে মারাত্বক হবে দাজ্জাল। তার ফেতনাই হবে সর্বাধিক বিভ্রান্তিকর। হযরত নবী কারীম (সাঃ) তার এত বেশী হাল-হাকীকত বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, তার আগমনের সময় সে যে পথভ্রষ্ট, এ বিষয়ে কারো মনে সন্দেহ থাকবে না। এমনিভাবে পরবর্তীকালে আগমনকারী সংস্কারক ও অনুসরণযোগ্য মনীষিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হবেন হযরত ঈসা (আঃ)। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাতের সম্মানে ভূষিত করেছেন; দাজ্জালের ফিতনার সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাহায্যের জন্যে আকাশে জীবিত রেখেছেন এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দাজ্জাল হত্যার জন্যে নিয়োজিত হবেন। এ কারণে তার জীবনালেখ্য ও গুণাবলী মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ফুটিয়ে তোলা প্রয়োজন ছিল, যাতে তাঁর অবতরণের সময় তাঁকে চেনার ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহ ও বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে।
এর রহস্য ও উপযোগিতা অনেক। প্রথম, তাঁর পরিচয়ে জটিলতা থাকলে তাঁর অবতরণের উদ্দেশ্যই পন্ড হয়ে যাবে। মুসলিম সম্প্রদায় তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে না। ফলে তিনি কিভাবে তাদের সাহায্য করবেন?
দ্বিতীয়, হযরত ঈসা (আঃ) সে সময় নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনে আদিষ্ট হয়ে জগতে আসবেন না; বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদানের উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করবেন, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি স্বীয় নবুওয়াতের পদ থেকে অপসারিতও হবেন না। তখন তিনি হবেন প্রাদেশিক শাসকের মত, যিনি নিজ প্রদেশের শাসক পদে অধিষ্টিত থেকেও প্রয়োজন বশতঃ অন্য প্রদেশে চলে যান। তিনি এ প্রদেশে শাসক হিসেবে না এলেও নিজ প্রদেশের শাসক পদ থেকে অপসারিতও নন। মোটকথা এই যে, হযরত ঈসা (আঃ) তখনও নবুওয়াত ও রিসালাতের গুণে গুণান্বিত হবেন। তাঁকে অস্বীকার করা পূর্বে যেরূপ কুফর ছিল, তখনও কুফর হবে। এমতাবস্থায় মুসলিম সম্প্রদায় যারা কুরআনী নির্দেশের ভিত্তিতে পূর্ব থেকেই তাঁর প্রতি বিশ্বাসী- যদি অবতরণের সময় তাঁকে চিনতে না পারে, তবে অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়ে পড়বে।
তৃতীয়, ঈসা (আঃ)-এর অবতরণের ঘটনা দুনিয়ার অন্তিম পর্যায়ে সংঘটিত হবে। এমতাবস্থায় তাঁর অবস্থা ও লক্ষণাদি অস্পষ্ট হলে অন্য কোন প্রতারকের পক্ষ থেকে এরূপও দাবী করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল যে, আমিই মসীহ ঈসা ইবনে মারয়াম। এখন কেউ এরূপ করলে লক্ষণাদির সাহায্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করা যাবে। উদাহরণতঃ হিন্দুস্থানে এক সময় মির্যা কাদিয়ানী দাবী করে বসে যে, সে-ই প্রতিশ্রুত মসীহ। মুসলমান ওলামাগণ এসব লক্ষণের সাহায্যের তার এ ভ্রান্ত দাবী প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিপদাপদ মুমিনদের জন্যে প্রায়শ্চিত্য স্বরূপঃ فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ এ আয়াতের বিষয়বস্তুতে সামান্য একটা প্রশ্ন দেখা দেয় যে, কিয়ামতের মীমাংসার বর্ণনায় একথা বলার মানে কি যে, ইহকাল ও পরকালে শাস্তি দেব? কারণ, তখন তো ইহকালের শাস্তি হবেই না।
এর সমাধান এই যে, এ কথাটি অপরাধীকে লক্ষ্য করে বিচারকের এরূপ উক্তির মতই যে, এখন তোমাকে এক বছর শাস্তি ভোগ করতে হবে। এমতাবস্থায় পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হলে নিশ্চিতরূপেই দুই বছরের সাজা হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে এক বছরের সাথে অতিরিক্ত এক বছর যুক্ত হয়ে মোট দুই বৎসর সাজা হবে।
আলোচ্য আয়াতেও তদ্রুপ বোঝা দরকার। ইহকালের সাজা তো হয়েই গেছে। এর সাথে পরকালের সাজা যুক্ত হয়ে কিয়ামতের দিন মোট সাজা পূর্ণ করা হবে। অর্থাৎ, ইহকালের সাজা পরকালের সাজার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। কিন্তু মুমিনদের অবস্থা এর বিপরীত। ইহকালে তাদের উপর কোন বিপদাপদ এলে গোনাহ মাফ হয়। এবং পরকালের দন্ড লঘু অথবা রহিত হয়। সে কারণেই لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ বাক্যে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, মুমিনগণ ঈমানের কারণে আল্লাহর প্রিয়। প্রিয়জনের সাথে এমনি ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে কাফেররা কুফরের কারণে আল্লাহ্র ঘৃণার পাত্র। ঘৃণিতদের সাথে এরূপ ব্যবহার করা হয় না। -(বায়ানুল কুরআন)
কিসাসের প্রামাণ্যতাঃ إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কিয়াসও শরীয়তসম্মত প্রমাণ। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ ঈসা (আঃ)-এর জন্ম আদমের জন্মের অনুরূপ। অর্থাৎ, আদম (আঃ)-কে যেমন জনক (ও জননী) ব্যতিত সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসা (আঃ)-কেও তদ্রূপ জনক ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঈসা (আঃ)-এর সৃষ্টিকে আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির উপর কিয়াস করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। -(মাযহারী)
মুবাহালার সংজ্ঞাঃ ……… فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ এ আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা মহানবী (সাঃ)-কে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালার সংজ্ঞা এইঃ যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লা’নতের অর্থ আল্লাহ্র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহ্র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই খোদায়ী ক্রোধের নিকটবর্তী হওয়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ্র ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তাঁর প্রতিফল ভোগ করবে। সেসময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্নীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।