আন-নিসা, আয়াত ১৫৫-১৭৬

পৃষ্ঠা নং ৩০১

গোমরাহী আর প্রত্যেকটি গোমরাহীর পরিণামই জাহান্নাম। রসূল মকবুল (সাঃ)-এর কথা বা কার্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে বিষয়ের সমর্থন পাওয়া যায় না, এরূপ কোন বিষয়কে সওয়াবের কাজ মনে করাই বিদ‘আত।

হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ) লিখেছেনঃ “ইসলামের দৃষ্টিতে বিদ‘আতকে চরম অপরাধ এ জন্য বলা হয়েছে যে, এটাই দ্বীন ও শরীয়তকে বিকৃত করার প্রধান হাতিয়ার ও চিরাচরিত পন্থা। পূর্ববর্তী উম্মতগণেরও প্রধান ব্যাধি ছিল যে, তারা নিজেদের নবী ও রসূলগণের মৌলিক শিক্ষার উপর নিজেদের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করেছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা কি কি বর্ধিত করেছে আর আসল বিষয়টা কি ছিল, তা জানারও কোন উপায় ছিল না।

দ্বীনকে বিকৃত করার কারণ ও পন্থাসমূহ কি কি, কোনও গুপ্তপথে যাতে এ মহামারী উম্মতে-মোহাম্মদীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, তজ্জন্য ইসলামী শরীয়তে কিভাবে প্রতিটি পথে সতর্ক ও শক্তিশালী প্রহরা মোতায়েন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ) তদীয় ‘হুজ্জাতুল্লাহিল-বালেগাহ’ কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

ধর্মীয় নেতাদের প্রতি ভক্তি ও সম্মানের মধ্যপন্থাঃ উক্ত কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, নবী-কারীম (সাঃ)-এর কঠোর হুঁশিয়ারী এবং শরীয়তের কঠিন বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও বর্তমান মুসলিম সমাজ ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ির শিকারে পরিণত হয়েছে। দ্বীনের প্রতিটি শাখায় এই লক্ষণ সুস্পষ্ট ও উদ্বেগজনক। দ্বীন ও ঈমানের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ও মারাত্মক হচ্ছে ধর্মীয় নেতাদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার আতিশয্য অথবা অবহেলা ও অবজ্ঞার মনোবৃত্তি। একদল মনে করছে যে, ধর্মীয় আলেম-ওলামা, পীর-বুযুর্গাণের কোন প্রয়োজনই নেই; আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট। কারণ, তারাও মানুষ আমরাও মানুষ। এমনোভাবাপন্ন কোন কোন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি আরবী ভাষায়ও অনভিজ্ঞ, কোরআনের হাকীকত ও নিগুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ। রসুলুল্লাহ (সাঃ)-ও সাহাবায়ে-কেরামের বর্ণিত ব্যাখ্যা ও তাফসীর সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হওয়া সত্ত্বেও, কয়েকখানি অনুবাদ পুস্তক পাঠ করেই নিজেকে কোরআনের সমঝদার মনে করে বসেছে। স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর প্রত্যক্ষ শাগরেদ অর্থাৎ, সাহাবায়ে-কেরাম কর্তৃক বর্ণিত ব্যাখ্যা ও তাফসীরের তোয়াক্কা না করে নিজেদের কল্পনা-প্রসূত মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে। অথচ তারা চিন্তা করে না যে, ওস্তাদ ছাড়া শুধু কিতাবই যদি যথেষ্ট হতো, তবে আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কোরআনের লিখিত কপি প্রত্যেকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সক্ষম ছিলেন-রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ওস্তাদরূপে প্রেরণের আবশ্যক হতো না। একথা শুধু আল্লাহর কিতাবের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দুনিয়ার যে কোন বিষয় বা শাস্ত্রের বই পুস্তক বা অনুবাদ পাঠ করেই কেউ উক্ত শাস্ত্রের পারদর্শী হতে পারে না। শুধু ডাক্তারী বই পড়েই আজ পর্যন্ত কেউ বড় ডাক্তার হতে পারে নাই। প্রকৌশল বিদ্যার বই অধ্যায়ন করেই কোন পারদর্শী প্রকৌশলী হয়েছে বলে শুনা যায় না। এমনকি দর্জিবিদ্যা বা পাক প্রণালীর শুধু বই পড়ে কোন সুদক্ষ দর্জী বা বাবুর্চি হতেও দেখা যায় না। বরং এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সর্বজন স্বীকৃত। অথচ তারা কোরআন-হাদীসকে এত হাল্কা মনে  করেছে যে, এগুলো বুঝার জন্য কোন ওস্তাদের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না। এটা সত্যই পরিতাপের বিষয়।

অনুরূপভাবে একদল শিক্ষিত লোক গড্ডালিকা প্রবাহে মেতে উঠেছে যে, কোরআন পাক বুঝার জন্য তর্জমা অদ্যয়নই যথেষ্ট। পূর্ববর্তী মনীষিগণের তাফসীর ও ব্যাখ্যার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা বা তাঁদের অনুসরণ-অনুকরণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নাই। আদতে এটাও এক প্রকার বাড়াবাড়ি বা অনধিকার চর্চা।

অপরদিকে বহু মুসলমান অন্ধ ভক্তিজনিত রোগে আক্রান্ত। যাকে তাদের পছন্দ হয়েছে, তাকেই নেতা সাব্যস্ত করে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে। তারা কখনো এতটুকু যাচাই করে দেখে না যে, আমরা যাকে নেতারূপে অনুসরণ করছি তিনি এলেম-আমল, এছলাহ ও পরহেযগারীর মাপকাঠিতে টিকেন কিনা? তারা যে শিক্ষা দিচ্ছেন তা কোরআন ও সুন্নাহ্ মোতাবেক কিনা? প্রকৃতপক্ষে এহেন অন্ধভক্তিও বাড়াবাড়িরই নামান্তর।

বাড়াবাড়ির উভয় পথ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ইসলামী শরীয়তের পথ-নির্দেশ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর কিতাব আল্লাহ ওয়ালা লোকদের কাছে বুঝতে হবে এবং আল্লাহর কিতাব দ্বারা আল্লাহ ওয়ালা লোকদের চিনতে হবে। অর্থাৎ, প্রথমে কোরআন ও হাদীসের নির্ধারিত নিরিখের আলোকে খাঁটি আল্লাহ্ ওয়ালাগণকে চিনে নাও। অতঃপর দেখ তাঁরা কোরআন ও হাদীসের চর্চায় সদা নিমগ্ন এবং তাদের জীবনধারাও কোরআন-হাদীসের রংয়ে রঞ্জিত কিনা। অতঃপর কোরআন ও হাদীসের সব জটিল প্রশ্নের সমাধানে তাঁদের অভিমত ও সিদ্ধান্তকে নিজের বুঝ-ব্যবস্থার উপর প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দিয়ে তার অনুসরণ করতে হবে।

আল্লাহর বান্দা হওয়াই সর্বোচ্চ মর্যাদার বিষয়ঃ لَّن يَسْتَنكِفَ الْمَسِيحُ أَن يَكُونَ عَبْدًا لِّلَّهِ  অর্থাৎ, হযরত ঈসা (আঃ) এবং আল্লাহ্ তাআলার নৈকট্য লাভকারী ফেরশতাগণ কখনো আল্লাহর বান্দারূপে পরিচিত হতে লজ্জা বা অপমান বোধ করেন না। কারণ, আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামি করা, তার এবাদত-বন্দেগী করা, আদেশ-নিষেধ পালন করা অতি মর্যাদা, গৌরভ ও সৌভাগ্যের বিষয়। হযরত ঈসা মসীহ (আঃ) ও হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রমুখ বিশিষ্ট ফেরেশতাগণ এ সম্পর্কে উত্তমরূপে অবহিত রয়েছেন। তাই এতে তাঁদের কোন লজ্জা নেই। আসলে আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা গোলামি করাই লজ্জা ও অমর্যাদার কাজ। যেমন, খৃষ্টানরা হযরত ঈসা মসীহ (আঃ)- কে আল্লাহর পুত্র ও অন্যতম উপাস্য সাব্যস্ত করেছে এবং মুশরেকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা ও দেবী সাব্যস্ত করে তাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা-অর্চনা শুরু করেছে। অতএব, তাদের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি ও অপমান অবধারিত রয়েছে।–(ফাওয়ায়েদে-উসমানী)

قَدْ جَاءَكُم بُرْهَانٌ مِّن رَّبِّكُمْ ‘বুরহান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অকাট্য দলীল-প্রমাণ। এ আয়াতে এর দ্বারা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র সত্তা ও মহান ব্যক্তিত্বকে বোঝানো হয়েছে।– (তাফসীরে রুহুল-মা’আনী)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ‘বুরহান’ শব্দ প্রয়োগ করার তাৎপর্য এই যে, তাঁর বরকতময় সত্তা, অনুপম চরিত্র মাধুর্য, অপূর্ব মো’জেযাসমূহ, তাঁর প্রতি বিস্ময়কর কিতাব আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়া ইত্যাদি তাঁর রেসালতের অকাট্য দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার পরে আর কোন সাক্ষ্য-প্রমাণের আবশ্যক হয় না। অতএব, তাঁর মহান ব্যক্তিত্বই তাঁর সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ