আল-বাকারা ১২০-১৩৪

পৃষ্ঠা নং-৬১

হযরত খলীলুল্লাহর মক্কায় হিজরত ও কা’বা নির্মাণের ঘটনাঃ

এই আয়াতে কা’বা গৃহের ইতিহাস, হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিমাচ্ছালাম) কর্তৃক কা’বা গৃহের পুনঃনির্মাণ, কা’বা ও মক্কার কতিপয় বৈশিষ্ট্য এবং কা’বা গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধি-বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়টি কুরআনের অনেক সূরায় ছড়িয়ে রয়েছে।

‘হারাম সম্পর্কিত মাসায়েল

(১) مَثَابَةً  শব্দ থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কা’বা গৃহকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। ফলে তা সর্বদাই মানবজাতির প্রত্যাবর্তনস্থল হয়ে থাকবে এবং মানুষ বরাবর তার দিকে ফিরে যেতে আকাঙ্খী হবে। মুফাস্‌সির শ্রেষ্ঠ হযরত মুজাহিদ বলেনঃ لايقضى احد منها وطرا অর্থাৎ, কোন মানুষ কা’বা গৃহের যিয়ারত করে তৃপ্ত হয় না, বরং প্রতি বারই যিয়ারতের অধিকতর বাসনা নিয়ে ফিরে আসে। কোন কোন ‘আলেমের মতে কা’বা থেকে ফিরে আসার পর আবার সেখানে যাওয়ার আগ্রহ ‘হজ্ব কবূল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ। সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রথমবার কা’বাগৃহ যিয়ারত করার যতটুকু আগ্রহ থাকে, দ্বিতীয়বার তা আরও বৃদ্ধি পায় এবং যতবারই যিয়ারত করতে থাকে, এ আগ্রহ উত্তরোত্তর ততই বেড়ে যেতে থাকে।

এবিস্ময়কর ব্যাপারটি একমাত্র কা’বারই বৈশিষ্ট্য। নতুন জগতের শ্রেষ্ঠতম মনোরম দৃশ্যও এক-দু’বার দেখেই মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। পাঁচ-সাতবার দেখলে আর দেখার ইচ্ছাই থাকে না। অথচ এখানে না আছে কোন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট, না এখানে পৌঁছা সহজ এবং না আছে ব্যবসায়িক সুবিধা, তা সত্ত্বেও এখানে পৌঁছার আকুল আগ্রহ মানুষের মনে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে। হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এখানে পৌঁছার জন্যে মানুষ ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

(২) এখানে اَمْنًا শব্দের অর্থ مأمن অর্থাৎ, শান্তির আবাসস্থল بيت শব্দের অর্থ শুধু কা’বা গৃহ নয়, বরং সম্পূর্ণ ‘‘হারাম। অর্থাৎ, কা’বা গৃহের পবিত্র প্রাঙ্গণ। কুরআনে بيت الله ও كعبة শব্দ বলে যে সম্পূর্ণ ‘‘হারামকে বোঝানো হয়েছে, তার আরও বহু প্রমাণ রয়েছে। যেমন, এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ هَدْيًا بٰلِغَ الكَعْبَةِ এখানে كعبة বলে সমগ্র ’হারামকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, এতে ক্বুরবানীর কথা আছে। ক্বুরবানী কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে হয় না এবং সেখানে ক্বুরবানী করা বৈধও নয়। কাজেই আয়াতের অর্থ হবে যে, ‘আমি কা’বার ‘‘হারামকে শান্তির আলয় করেছি।’ শান্তির আলয় করার অর্থ মানুষকে নির্দেশ দেয়া যে, এ স্থানকে সাধারণ হত্যা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অশান্তিজনিত কার্যকলাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।– (ইব্‌নে-‘আরাবী)।

(৩) وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ  এখানে মাক্বামে-ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। কা’বা নির্মাণের সময়  এ পাথরটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন।–(স‘হীহ্ বুখারী)

হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন, আমি এই পাথরে হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পদচিহ্ন দেখেছি। যিয়ারতকারীদের উপর্যুপুরি স্পর্শের দরুন চিহ্নটি এখন অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।–(ক্বুরতুবী)

হযরত ‘আবদুল্লাহ্ ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত রয়েছে যে, সমগ্র ‘‘হারামটিই মাক্বামে-ইব্‌রাহীম। এর অর্থ বোধ হয় এই যে, তওয়াফের পর দু’রকা‘আত নামায মাক্বামে-ইব্‌রাহীমে পড়ার নির্দেশ আলোচ্য আয়াতে রয়েছে, তা ‘হারামের যে কোন অংশে পড়লেই চলে। অধিকাংশ শাস্ত্রবিদ এ ব্যাপারে একমত।

(৪) আলোচ্য আয়াতে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমকে নামাযের জায়গা করে নিতে বলা হয়েছে। স্বয়ং রসুলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিদায় ‘হজ্বের সময় কথা ও কর্মের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা  করে দিয়েছেন। তিনি তওয়াফের পর কা’বা গৃহের সম্মুখে অনতিদূরে রক্ষিত মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের কাছে আগমন করলেন এবং এ আয়াতটি পাঠ করলেন وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ   অতঃপর মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে এমনভাবে দাঁড়িয়ে দু’রকা‘আত নামায পড়লেন যে, কা’বা ছিল তাঁর সম্মুখে এবং কা’বা ও তাঁর মাঝখানে ছিল মাক্বামে-ইব্‌রাহীম।–(স‘হীহ্ মুসলিম)

এ কারণেই ফিক্ব্‌হ্‌শাস্ত্রবিদগণ বলেছেনঃ যদি কেউ মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে সংলগ্ন স্থানে জায়গা না পায়, তবে মাক্বামে-ইব্‌রাহীম ও কা’বা উভয়টিকে সামনে রেখে যে কোন দূরত্বে দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নির্দেশ পালিত হবে।

(৫) আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তওয়াফ পরবর্তী দুই রকা‘আত নামায ওয়াজিব।– (জাসসাস, মোল্লা ‘আলী ক্বারী)

তবে এ দু’রকা‘আত নামায বিশেষভাবে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে পড়া সুন্নত। ‘হারামের অন্যত্র পড়লেও আদায় হবে। কারণ, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ দু’রকা‘আত নামায কা’বা গৃহের দরজা সংলগ্ন স্থানে পড়েছেন বলেও প্রমাণিত রয়েছে। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্লাহ ‘আনহু)ও তাই করেছেন বলে বর্ণিত আছে (জাসসাস)। মোল্লা ‘আলী ক্বারী মানাসেক গ্রন্থে বলেছেন, এ দু’রকা‘আত মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে পড়া সুন্নত। যদি কোন কারণে সেখানে পড়তে কেউ অক্ষম হয়, তবে ‘‘হারাম অথবা ‘হারামের বাইরে যে কোনখানে পড়ে নিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।

(৬) وطَهِّرْ بَيۡتِيَ এখানে কা’বা গৃহকে পাক-সাফ করার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যিক অপবিত্রতা ও আবর্জনা এবং আত্মিক অপবিত্রতা উভয়টিই এর অন্তর্ভূক্ত। যেমন, কুফ্‌র্, শির্‌ক্, দুশ্চরিত্রতা, হিংসা, লালসা, কুপ্রবৃত্তি, অহঙ্কার, রিয়া, নাম-যশ ইত্যাদির কলুষ থেকেও কা’বা গৃহকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশে بَيۡتِيَ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ আদেশ যে কোন মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, সব মসজিদই আল্লাহ্‌র ঘর। কুরআনে বলা হয়েছেঃ

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرۡفَعَ

হযরত ফারূকে আ’যম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) মসজিদে এক ব্যক্তিকে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনে বললেনঃ তুমি কোথায় দাঁড়িয়া আছ, জান না? (কুরতুবী) অর্থাৎ, মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, এতে উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত নয়। মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে কা’বা গৃহকে যেমন যাবতীয় বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য মসজিদকেও পাক-পবিত্র রাখতে হবে। দেহ ও পোশাক-পরিচ্ছদকে যাবতীয় অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে পাক-সাফ করে এবং অন্তরকে কুফ্‌র্, শির্‌ক্, দুশ্চরিত্রতা, অহঙ্কার, হিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদি থেকে পবিত্র করে মসজিদে প্রবেশ করা কর্তব্য। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে বারণ করেছেন। তিনি ছোট শিশু এবং-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ