আল-বাকারা ২৩৩-২৫৬

পৃষ্ঠা নং-১৩২

বারটি অবস্থা নির্ধারিত হয়েছে। তন্মধ্যে এ আয়াতে দু’টি অবস্থার হুকুম বর্ণিত হয়েছে। তার একটি হচ্ছে এই, যদি মোহর ধার্য করা না হয়। দ্বিতীয়টি, মোহর ধার্য করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু স্ত্রীর সাথে নির্জনবাস বা সহবাস হয়নি। তৃতীয়তঃ মোহর ধার্য হয়েছে এবং সহবাসও হয়েছে। এক্ষেত্রে ধার্যকৃত মোহর সম্পূর্ণই পরিশোধ করতে হবে। কুরআন করীমে অন্য জায়গায় এ বিষয়টি বর্ণিত। চতুর্থতঃ মোহর ধার্য করা হয়নি, অথচ সহবাসের পর তালাক দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পরিবারে প্রচলিত মোহর পরিশোধ করতে হবে। এর বর্ণনাও অন্য এক আয়াতে এসেছে।

আলোচ্য আয়াতে প্রথম দুই অবস্থার আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম অবস্থার নির্দেশ হচ্ছে, মোহর কিছুই ওয়াজিব নয়। তবে নিজের পক্ষ থেকে স্ত্রীকে কিছু দিয়ে দেয়া স্বামীর কর্তব্য। ন্যুনপক্ষে তাকে এক জোড়া কাপড় দিয়ে দেবে। কুরআন-মজীদ প্রকৃতপক্ষে এর কোন পরিমাণ নির্ধারণ করেনি। অবশ্য একথা বলেছে যে, ধনী ব্যক্তিদের পক্ষে তাদের মর্যাদানুযায়ী দেয়া উচিত, যাতে অন্যেরাও অনুপ্রাণিত হয় যে, সামর্থ্যবান লোক এহেন ব্যাপারে কার্পণ্য করে না। হযরত হাসান (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) এমনি এক ব্যাপারে বিশ হাজারের উপঢৌকন দিয়েছিলেন। আর কাযী শোরাইহ্ পাঁচশ দেরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) দিয়েছেন। হযরত ইবনে-আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, নিম্নতম পরিমাণ হচ্ছে এক জোড়া কাপড়।–(কুরতবী)

দ্বিতীয় অবস্থায় হুকুম হচ্ছে এই যে, যদি স্ত্রীর মোহর বিয়ের সময় ধার্য করা হয়ে থাকে এবং তাকে সহবাসের পূর্বে তালাক দেয়া হয়, তবে ধার্যকৃত মোহরের অর্ধেক দিতে হবে। আর যদি স্ত্রী তা ক্ষমা করে দেয়া কিংবা স্বামী পুরো মোহরই দিয়ে দেয়, তবে তা হচ্ছে তাদের ঐচ্ছিক ব্যাপার। যেমন, আয়াতে বলা হয়েছেঃ

 إِلَّآ أَن يَعۡفُونَ أَوۡ يَعۡفُوَاْ الَّذِي بِيَدِهِۦ عُقۡدَةُ النِّكَاحِۚ পুরুষের পূর্ণ মোহর দিয়ে দেওয়াকেও হয়তো এজন্য মাফ করা বলা হয়েছে যে, আরবের সাধারণ প্রথা অনুযায়ী বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মোহরের অর্থ দিয়ে দেয়া হতো। সুতরাং সহবাসের পূর্বে তালাক দিলে অর্ধেক স্বামীর প্রাপ্য হয়ে যেতো। যদি সে বদান্যতার প্রেক্ষিতে অর্ধেক না নেয়, তবে তাও ক্ষমার পর্যায়ে পড়ে এবং ক্ষমা করাকে উত্তম ও তাকওয়ার পক্ষে অনুকুল বলা হয়েছে। কেননা, তালাকটি যে ভদ্রোচিত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই ক্ষমা তারই নিদর্শন-যা শরীয়তের দৃষ্টিতে উত্তম এবং সওয়াবের কাজ। তাই ক্ষমা স্ত্রীর পক্ষ থেকেও হতে পারে, স্বামীর পক্ষ হতেও হতে পারে।

الَّذِي بِيَدِهِۦ عُقۡدَةُ النِّكَاحِ – এর তফসীর রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে বর্ণনা করেছেন। বিবাহ বন্ধনের মালিক হচ্ছে স্বামী। এ ‘হাদীসটি দারুকুতনী গ্রন্থে আমর ইবনে শো’আইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। আর হযরত আলী (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) এবং ইবনে-আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকেও উদ্ধৃত করেছেন। (কুরতুবী)

এতে একথা প্রমাণিত হয় যে, বিয়ে সমাধা হওয়ার পর তা বহাল রাখা বা ভঙ্গ করার মালিক স্বামী। সে-ই তালাক দিতে পারে। স্ত্রীলোকের পক্ষে তালাক দেয়ার সুযোগ সীমিত।

কতিপয় হাদীসের প্রমাণ অনুসারে অধিকাংশ আলেমের মতে মধ্যবর্তী নামায অর্থ হচ্ছে আসরের নামায। কেননা, এর একদিকে দিনের দু’টি নামায- ফজর ও যোহর এবং অপরদিকে রাতের দু’টি নামায- মাগরিব ও এশা রয়েছে। এ নামাযের প্রতি তাগিদ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, অনেক লোকেরই এ সময় কাজকর্ম ব্যস্ততা থাকে। আর হাদীসে ‘কানেতীন বা আনুগত্যের’ সাথে বাক্যটির ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘নীরবতার সাথে’।

এ আয়াতের দ্বারা নামাযের মধ্যে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ইতিপূর্বে জায়েয ছিল। আর এ নামায দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইশারার দ্বারা পড়া তখনই শুদ্ধ হবে যখন একই স্থানে দাঁড়িয়ে পড়া সম্ভব। ইশারার ক্ষেত্রে সেজদার ইশারা রুকূর ইশারার চেয়ে একটু বেশী নীচু করবে। চলতে চলতে নামায হবে না। যখন এমনভাবে পড়াও সম্ভব হবে না। (যেমন যুদ্ধ চলাকালে) তখন নামায কাযা করতে হবে এবং অন্য সময় আদায় করবে।– (বয়ানুল কুরআন)

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوۡنَ مِنكُمۡ ….. وَاللهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ (১) জাহেলিয়াত আমলে স্বামীর মৃত্যুর দরুন ‘ইদ্দত ছিল এক বৎসর। কিন্তু ইসলামে এক বৎসরের স্থলে চার মাস দশ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন-পূর্ববর্তী আয়াতে বলে দেয়া হয়েছেঃ

يَتَرَبَّصۡنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرۡبَعَةَ أَشۡهُرٍ وَّعَشۡرًاۖ

–কিন্তু এতে স্ত্রীকে এতটুকু সুবিধা দেওয়া হয়েছিল যে, যেহেতু তখনও পর্যন্ত মিরাসের বিধান নাযিল হয়নি এবং মিরাসে কোন অংশ স্ত্রীলোকের জন্য নির্ধারণ করা হয়নি, বরং তাদের ভাগ্য পুরুষের ওসিয়্যতের উপর নির্ভরশীল ছিল যা পূর্ববর্তী আয়াত كُتِبَ عَلَيْكُمْ اِذَاحَضَرَ এর তফসীরে বোঝা গেছে। কাজেই নির্দেশ হয়েছিল যে, যদি স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী নিজের সুবিধার জন্য স্বামীর পরিত্যক্ত বাড়ীতে থাকতে চায়, তবে এক বৎসর পর্যন্ত থাকার অধিকার রয়েছে এবং তারই পরিত্যক্ত অর্থ-সম্পদ থেকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ‘ইদ্দতের সময় পর্যন্ত দিতে হবে।

এ আয়াতে সেই নির্দেশটিই বর্ণনা করা হয়েছে আর স্বামীদেরকে সেভাবেই ওসিয়ত করতে বলা হয়েছে। আর যেহেতু এ অধিকারটি ছিল স্ত্রীর তাই তা আদায় করা না করার অধিকারও ছিল তারই। মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের জন্য তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া জায়েয ছিল না। ‘ইদ্দত শেষ হওয়ার পর সে তার অংশ ছেড়েও দিতে পারতো। আর অন্যত্র বিয়ে করাও জায়েয ছিল। এখানে ‘নিয়মানুযায়ী’ শব্দের অর্থ তাই। কিন্তু ‘ইদ্দতের মধ্যে ঘর থেকে বের হওয়া বা বিয়ে করা ইত্যাদি ছিল পাপের কাজ। স্ত্রীলোকের জন্যও এবং বাধা দিতে পারা সত্ত্বেও যারা বাধা না দেয় তাদের জন্যও। পরে যখন মিরাসের আয়াত অবতীর্ণ হয়, তখন বাড়ী-ঘর এবং অন্যান্য সব কিছুর মধ্যেই যেহেতু স্ত্রীকেও অংশ দেয়া হয়েছে, কাজেই সে তার নিজের অংশে থাকার এবং নিজের অংশ থেকে ব্যয় করার পূর্ণ অধিকারী রয়ে গেছে। ফলে এ আয়াতটির সরাসরি নির্দেশ রহিত হয়ে গেছে।

(২) وَلِلۡمُطَلَّقَٰتِ مَتَٰعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোকের উপকার করার কথা এর পূর্ববর্তী আয়াতেও এসেছে। তবে তা ছিল শুধু দু’রকম তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর জন্য। সহবাস কিংবা নির্জনবাসের পূর্বে যাদেরকে তালাক দেয়া হয়েছে, তাদের একটি উপকার ছিল কমপক্ষে একজোড়া কাপড় দেয়া। আর দ্বিতীয় উপকার হচ্ছে অর্ধেক মোহর দেয়া। বাকী রইল সে সমস্ত তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যাদের যাথে স্বামীর নির্জনবাস কিংবা সহবাস করেছে। তাদের মধ্যে যাদের মোহর ধার্য করা হয়েছে, তাদের উপকার করা অর্থ, তার ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর দিয়ে দেয়া। আর যার মোহর ধার্য করা হয়নি তার জন্য মোহরে-মিসাল দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর যদি مَتَٰعُۢ শব্দের দ্বারা ‘বিশেষ ফায়দা’ বলতে একজোড়া কাপড় বোঝানো হয়, তবে একজনকে তা দেয়া ওয়াজিব, যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। আর অন্যান্যদের বেলায় তা মোস্তাহাব। আর যদি مَتَٰعُۢ শব্দের দ্বারা খোর-পোষ বোঝানো হয়ে থাকে, তবে যে তালাকের পর ‘ইদ্দত অতিক্রান্ত করতে হয়, তাতে ‘ইদ্দত পর্যন্ত তা দেয়া ওয়াজিব তালাকে-রাজয়ীই হোক আর তালাকে-বায়েনই হোক ব্যাপক অর্থে সব ধরনের তালাকই এর অন্তর্ভুক্ত।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ