আল-বাকারা ২৭৫-২৮৬

পৃষ্ঠা নং-১৫৩

বিধান নাযিল হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা রিবার লেন-দেনও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘আরবরা যাকে রিবা বলতো এবং যার লেন-দেন করতো, কুরআন তাকেই ‘হারাম করেছিল। রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ বিধানকে শুধুই নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, দেশের আইন হিসাবেও জারি করেন। তবে এমন কতকগুলো প্রকারকেও তিনি রিবার অন্তর্ভূক্ত করে দেন যেগুলোকে সাধারণভাবে রিবা বলে মনে করা হতো না। এসব প্রকার নির্ধারনের ব্যপারেই হযরত ফারুকে আ’যমের (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) মনে খটকা দেখা দিয়েছিল। এবং এগুলোর ব্যাপারেই মুজতাহিদ ইমামগন মতভেদ পোষন করেছেন, প্রচলিত রিবা সম্পর্কে কারও কোন সন্দেহ ছিলনা এবং কেউ এনিয়ে কোন মতভেদও করেননি।

তাফসীরবিদ ইবনে জারীর মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেনঃ “জাহেলিয়াত আমলে প্রচলিত ও কুরআনে নিষিদ্ধ ‘রিবা’ হল কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহন করা।” আরবরা তাই করতো এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সুদ বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হত। (তাফসীর ইবনে-জারীর তয় খন্ড ৬২ পৃঃ।)

স্পেনের খ্যাতনামা তাফসীরবিদ আবূ ‘হাইয়ান গানরাতী রচিত ‘তাফসীরে-বা‘হরে মু‘হীতে’ও জাহেলিয়াত আমলে প্রচলিত রিবার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি এ রূপই বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ তারা অর্থ লগ্নি করে মুনাফা গ্রহণ করতো এবং ঋণের মেয়াদ যতই বেড়ে যেতো, ততই চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়িয়ে দেয়া হতো। এরাই বলতো যে, ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে মুনাফা নেয়া যেমন জায়েয, তেমনি অর্থ ঋণ দিয়ে মুনাফা নেয়াও তদ্রুপ জায়েয হওয়া উচিত। কুরআন পাক একে ‘হারাম করেছে এবং ক্রয়-বিক্রয় ও রিবার মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছে।

রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহ ওয়াসাল্লাম)বলেনঃكل قرض جر نفعها فهو ربا  অর্থ্যাৎ, যে ঋণ কোন মুনাফা টানে, তাই রিবা। (জামে’-সগীর)

তবে নবী কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কয়েক রকম ক্রয়-বিক্রয়কে ও রিবার অন্তর্ভূক্ত করেছেন। আরবরা এগুলোকে রিবা মনে করতোনা। উদাহরণতঃ তিনি ছয়টি বস্তু সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন যে, এগুলো অদল-বদল করতে হলে সমান সমান এবং নগদে হওয়া দরকার। কম-বেশী কিংবা বাকী হলে তাও রিবা হবে। এ ছয়টি বস্তু হচ্ছে সোনা, রূপা, গম, যব, খেজুর ও আঙ্গুর।

‘আরবে ‘মুযাবানা’ ও ‘মুহাকালা’ নামে কাজ কারবারের কয়েকটি প্রকার প্রচলিত ছিল। বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ থেকে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রয় করাকে ‘মুযাবানা’ বলা হয় এবং ক্ষেতে অকর্তিত খাদ্যশস্য যথা- গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনা পরিস্কার করা খাদ্য যথা-গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রয় করাকে ‘মুহাকালা’ বলা হয়।

সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। (ইবনে কাসীর)

এতে প্রনিধানযোগ্য বিষয় ছিল এই যে, বিশেষ করে উপরোক্ত ছয়টি বস্তুর মধ্যেই সুদ সীমাবদ্ধ, না এগুলো ছাড়া আরও কিছু বস্তু এ নির্দেশের অন্তর্ভক্ত হবে? হযরত ফারূকে আ’যম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) এ সব প্রশ্নের সন্মুখীন হয়েই নিন্মোক্ত উক্তি করেছিলেন যে,

‘সুদের আয়াত হচ্ছে কুরআন পাকের সর্বশেষ আয়াতসমুহের অন্যতম। এর পূর্ণ বিবরণ দান করার পূর্বেই রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাই এখন সতর্ক পদক্ষেপ জরুরী। সুদ তো অবশ্যই বর্জন করতে হবে, তদুপরি যেসব ব্যাপারে সুদের সন্দেহও হয়, সেগুলোও পরিহার করা উচিত। (আ‘হকামুল কুরআন-জাস্‌সাস, ইবনে-কাসীর)

ফারূকে আ’যম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর উদ্দেশ্য ক্রয়-বিক্রয়ে ঐসব প্রকারকেও রিবার অন্তর্ভূক্তিকরণ ছিল, যেগুলোকে জাহেলিয়াত যুগের ‘আরবে সুদ মনে করা হতো না। রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এগুলোকে সুদের অন্তর্ভূক্ত করে ‘হারাম করেছিলেন। আসল ‘রিবা’ বা সুদ যা সমগ্র ‘আরবে সুবিদিত ছিল, সাহাবায়ে কেরাম যা ত্যাগ করেছিলেন এবং রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে সম্পর্কে আইন জারি করে বিদায় হজ্বের ভাষনে ঘোষনা করেছিলেন, সে সুদ সম্পর্কে ফারূকে আ’যমের মনে কোনরূপ খটকা বা সন্দেহ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে এরূপ চিন্তাও করা যায়না। কিন্তু সুদের যেসব প্রকার সম্পর্কে তিনি সন্দিগ্ধ ছিলেন, সেগুলোর ব্যাপারে তিনি সমাধান প্রদান করেন যে, যে সব ব্যপারে সুদের সন্দেহ হয়, সেগুলোও পরিত্যাগ করতে হবে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আজকাল কিছু সংখ্যক লোক, যারা পাশ্চাত্যের বাহ্যিক জাঁকজমক, ধনাঢ্যতা এবং বর্তমান বানিজ্যনীতি ইত্যাদিতে সুদের প্রধান্য বিস্তারের মোহে মোহগ্রস্ত, তারা ফারূকে আ’যমের উপরোক্ত উক্তির ব্যাখা এই বের করেছে যে, ‘‘রিবা’র অর্থই অস্পষ্ট ও অব্যক্ত ছিল। কাজেই এতে গবেষনার অবকাশ রয়েছে। তাদের এ অভিমত যে ভ্রান্ত, তার যথেষ্ট প্রমানাদি বর্ণিত হয়েছে।

‘আ‘হকামুল কুরআনে ইবনে ‘আরবী এ শ্রেনীর লোকদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, যারা ফারুকে আ’যমের উপরোক্ত উক্তির ভিত্তিতে সুদের আয়াতকে অস্পষ্ট বলে অভিহিত করতে চেয়েছে। তিনি বলেনঃ যারা রিবার আয়াতকে অস্পষ্ট  বলেছেন, তারা শরি‘আতের অকাট্য বিষয়সমূহ বোঝতে সক্ষম হয়নি। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় রসূলকে একটি মানবগোষ্টির নিকট প্রেরণ করেছেন এবং তাদেরই ভাষায় প্রেরণ করেছেন। স্বীয় গ্রন্থ সহজ করার জন্য তাদেরই ভাষায় তা অবতীর্ণ করেছেন। তাদের ভাষায় ‘রিবা’ শব্দের অর্থ অতিরিক্ত। আয়াতে ঐ অতিরিক্তটুকুকে বোঝানো হয়েছে। যার বিপরীতে কোন সম্পদ নেই বরং মেয়াদ আছে।

ইমাম রাযী তাফসীর কাবীরে বলেনঃ রিবা দুরকমঃ (এক) বাকী বিক্রয়ের রিবা এবং (দুই) নগদ ক্রয় বিক্রয়ে বেশী নেয়ার রিবা। প্রথম প্রকার জাহেলিয়াত যুগে প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত ছিল। সে যুগের লোকেরা এরূপ লেনদেন করতো। দ্বিতীয় প্রকার রিবা সম্পর্কে ‘হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে অমুক অমুক বস্তুর ক্রয় বিক্রয়ে কম বেশী করা রিবার অন্তর্ভক্ত।

জাস্‌সাসের আ‘হকামুল কুরআনে বলা হয়েছেঃ রিবা দুরকমঃ একটি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে এবং অপরটি ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া। দ্বিতীয় প্রকারই ছিল জাহেলিয়াত যুগের রিবা। এর সজ্ঞা এইযে, যে ঋণে মেয়াদের হিসাবে কোন মুনাফা নেয়া হয়, তাই রিবা। ইবনে-রূশ্‌দ্ “বিদায়াতুল মুজতাহিদ” গ্রন্হে তাই লিখেছেন। তিনি এ রিবার অবৈধতা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দ্বারা প্রমান করেছেন।

ইমাম ত‘হাবী “শর‘হে মা‘আ-নিউল-আসার” গ্রন্হে এ বিষয়ে বিস্তারীত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেনঃ কুরআনে উল্লেখিত ‘রিবা’ দ্বারা পরিস্কার ও সুস্পষ্টভাবে সে রিবাকেই বোঝান হয়েছে, যা ঋণের উপর নেয়া হতো। জাহেলিয়াত যুগেও একেই রিবা বলা হতো। এরপর রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণনাও তাঁর সুন্নত থেকে অন্য প্রকার রিবার বিষয় জানা-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ