আল-মায়িদাহ, আয়াত ১-৫

পৃষ্ঠা নং-৩০৮

ইবনে মাজাহ, দারেকুতনী, বায়হাকী)

আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত দ্বিতীয় ‘হারাম বস্তু হচ্ছে রক্ত। কুরআনের অন্য আয়াতে  أَوْ دَماً مَّسْفُوحاَ বলায় বুঝা যায় যে, যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই ‘হারাম। সুতরাং কলিজা ও প্লীহা রক্ত হওয়া সত্বেও ‘হারাম নয়। পূর্বোক্ত যে ‘হাদীসে মাছ ও টিড্ডীর কথাও বলা হয়েছে, তাতেই কলিজা ও প্লীহা ‘হালাল হওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

তৃতীয় বস্তু শূকরের মাংস। একেও ‘হারাম করা হয়েছে। মাংস বলে তার সম্পুর্ণ দেহ বুঝানো হয়েছে। চর্বি ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত।

চতুর্থ ঐ জন্তু যা আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। যদি জবেহ্ করার সময়ও অন্যের নাম নেওয়া হয়, তবে তা খোলাখুলি শির্‌ক্। এরূপ জন্ত সর্বসম্মতভাবে মৃতের অন্তর্ভূক্ত। যেমন ‘আরবের মুশরিকরা মূর্তিদের নামে যবেহ্ করতো। অধুনা কোন কোন মূর্খ লোক পীর-ফকীরের নামে যবেহ্ করে। যদিও যবেহ্ করার সময় আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করে কিন্ত জন্তটি যেহেতু অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত এবং তার সন্তষ্টির জন্যে কুরবানী করে, তাই সাধারণ ফেকাহবিদগণ একেও وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِاللهْ بِهِ আয়াত দৃষ্টে ‘হারাম করেছেন।

পঞ্চম مُنْخَنِقَةُ অর্থাৎ ঐ জন্তু হা‘রাম, যাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে অথবা নিজেই কোন জাল ইত্যাদিতে আবদ্ধ অবস্হায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে।

ষষ্ঠ مَوْقُوْذَةُ অর্থাৎ ঐ জন্তু ‘হারাম , যা লাঠি অথবা পাথর ইত্যাদির প্রচন্ড আঘাতে নিহত হয়। যদি নিক্ষিপ্ত তীরের ধারাল অংশ শিকারের গায়ে না লাগে এবং তীরের আঘাতে শিকার নিহত হয়, তবে সে শিকারও مَوْقُوْذَةُ এর অন্তর্ভূক্ত এবং হারাম। مُنْخَنِقَةُ এবং مَيْتَةُ উভয়টি مَوْقُوْذَةُ তথা মৃতের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু জাহিলিয়াত যুগে এগুলোকে জায়েয মনে করা হতো। এ কারণে আয়াতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত ‘আদী ইবনে হাতেম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) একবার রসুলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ আমি মাঝে মাঝে চওড়া তীর দ্বারা শিকার করি। যদি এতে শিকার মরে যায়, তবে খেতে পারি কি না? তিনি উত্তরে বললেনঃ তীরের যে অংশ ধারাল নয়, যদি সে অংশের আঘাতে শিকার মরে যায়, তবে তা مَوْقُوْذَةُ এর অন্তর্ভূক্ত হবে এবং তুমি খেতে পারবে না। আর যদি ধারাল অংশ শিকারের গায়ে লাগে এবং শিকারকে আহত করে, তবে তা খেতে পার। ইমাম জাসসাস ‘আ‘হকামুল-কুরআন’ গ্রন্হে এ ‘হাদীসটি নিজ সনদে বর্ণনা করেছেন। এরূপ শিকার ‘হালাল হওয়ার জন্যে শর্ত এই যে, বিসমিল্লা-হ্ বলে তীর নিক্ষেপ করতে হবে।

যে শিকার বন্দুকের গুলিতে মরে যায়, ফেকাহবিদগণ সেটাকেও مَوْقُوْذَةُ এর অন্তর্ভূক্ত করে ‘হারাম বলেছেন। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলতেনঃ

الْمَقْتُولَةُ بِالْبُنْدُقَةِ تِلْكَ الْمَوْقُوذَةُ

অর্থাৎ বন্দুক দ্বারা যে জন্তুকে হত্যা করা হয়, তাই…. অতএব ‘হারাম। (জাসসাস)। ইমাম  আ’যম আবূ ‘হানিফা, শাফে‘য়ী, মালেক ( র‘হিমাহুমুল্ল-হ) প্রমুখ সবাই এ ব্যাপারে একমত।-( কুরতুবী)

সপ্তম مُتَرَدِّيَةُ  অর্থাৎ ঐ জন্তু হারাম, যা কোন পাহাড়, টিলা,উচু দালানের উপর থেকে অথবা কূপে পড়ে মরে যায়।এ কারণেই হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসুদ বলেনঃ যদি তুমি পাহাড়ের উপর দন্ডায়মান কোন শিকারের প্রতি বিসমিল্লাহ বলে তীর নিক্ষেপ কর এবং তীরের আঘাতে সে নীচে পড়ে মরে যায়,তবে তা খেয়ো না। কারণ, এতে সম্ভাবনা আছে যে, শিকারটি তীরের আঘাতে না মরে নীচে পড়ে যাওয়ার কারণে মরে গেছে। এমতাবস্হায় তা المُتَرَدِّيَةُ এর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। এমনি ভাবে কোন পাখিকে তীর নিক্ষেপ করার পর যদি সেটি পানিতে পড়ে যায় তবে উহা খাওয়াও নিষিদ্ধ। কারণ এখানেও পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। -(জাসসাস)

অষ্টম نَطِيْحَةُ অর্থাৎ ঐ জন্ত হারাম,যা কোন সংঘর্ষে নিহত হয়। যেমন রেলগাড়ী,মোটর ইত্যাদির নীচে এসে মরে যায় অথবা কোন জন্তুর শিং- এর আঘাতে মরে যায়।

নবম ঐ জন্ত হারাম, যেটি কোন হিংস্র জন্তর কামড়ে মরে যায়। উপরোক্ত নয় প্রকার হারাম জন্তর বর্ণনা করার পর একটি ব্যাতিক্রম উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ অর্থাৎ এসব জন্তর মধ্যে কোনটিকে জীবিত অবস্হায় পাওয়ার পর যবেহ্ করতে পারলে হালাল হয়ে যাবে।

এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চার প্রকার জন্তর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। কেননা মৃত ও রক্তকে যবেহ্ করার সম্ভাবনা নাই এবং শূকর এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত জন্ত সত্তার দিক দিয়েই হারাম। এ দুটোকে যবেহ্ করা না করা উভয় সমান। এ কারণে হযরত আলী (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ), হাসান বসরী, কাতাদাহ প্রমুখ পূর্ববতী মনীষীগণ এ বিষয়ে একমত যে, এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চারটি পরবর্তী পাঁচটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। অতএব আয়াতের অর্থ এই দাড়ায় যে, এ পাঁচ প্রকার জন্তর মধ্যে যদি জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যায় এবং তদবস্হায়ই বিসমিল্লাহ বলে যবেহ্ করে দেয়া হয়, তবে এগুলো খাওয়া হালাল হবে।

দশম, ঐ জন্ত হারাম, যাকে নুছুবের উপর যবেহ্ করা হয়। নুছুব ঐ প্রস্তরকে বলা হয়, যা কাবা গৃহের আশে পাশে স্হাপিত ছিল। জাহিলিয়াত যুগে আরবরা এদের উপাসনা করত এবং এদের কাছে এদের উদ্দেশ্যে জন্ত কোরবানী করত। একে তারা এবাদত বলে গণ্য করত।

জাহিলিয়াত যুগে আরবরা উপরোক্ত সব প্রকার জন্তর মাংস ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিল। কোরআন পাক এগুলোকে হারাম করেছে।

একাদশ الاستقسام بالأزلام হারাম أزلام শব্দটি زلم এর বহুবচন। এর অর্থ ঐ তীর, যা জাহিলিয়াতের যুগে ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত ছিল। এ কাজের জন্য সাতটি তীর ছিল। তন্মধ্যে একটিতে نعم (হ্যা) একটিতে لا (না) এবং অন্য গুলোতে অন্য শব্দ লিখিত ছিল। এ তীরগুলো কাবা গৃহের খাদেমের কাছে থাকত। কেউ নিজ ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলে অথবা কোন কাজ করার পূর্বে তা উপকারী না অপকারী, তা জানতে চাইলে সে কাবার খাদেমের কাছে পৌছে একশত মুদ্রা উপটৌকন দিত খাদেম তূন থেকে একটি একটি করে তীর বের করত।’হ্যা’ শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হয়ে আসলে মনে করা হত যে কাজটি উপকারী। পক্ষান্তরে না শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হলে তারা বুঝে নিত যে কাজটি করা ঠিক হবে না। হারাম জন্তসমুহের বর্ণনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ এই যে, তারা এ তীরগুলো জন্তসমুহের মাংস বন্টনেও ব্যবহার করত। কয়েকজন শরীক হয়ে উট ইত্যাদি যবেহ্ করে তা মাংস প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী বন্টন না করে, এসব জুয়ার তীরের সাহায্যে বন্টন করত। ফলে কেউ সম্পূর্ণ বঞ্চিত, কেউ প্রাপ্য অংশের চাইতে কম এবং কেউ অনেক বেশী মাংস পেয়ে যেত। এ কারণে হারাম জন্তর বর্ণনা প্রসঙ্গে এ হারাম বন্টন পদ্ধতিও বর্ণনা করা হয়েছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ